বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নের নামে আশার গল্প শোনানো যেন একটা ট্র্যাডিশন হয়ে গেছে। প্রতি সরকারের সময়েই এমন কিছু ঘোষণা আসে যা দেখে জনগণের মনে হয় এবার কিছু একটা সত্যিই হতে যাচ্ছে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, এসবের ৯০%-ই হয় ভুল তথ্য, ভুল ব্যাখ্যা অথবা অপূর্ণ বাস্তবায়ন।
দুইটি খুব আলোচিত উদাহরণ — পেপাল ও গুগল পে।
২০০৯ সালের পর থেকে যতবারই সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বা ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কথা বলেছে, প্রায় প্রতিবারই “পেপাল আসছে” — এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণ:
সরকার বলেছিল — “ফ্রিল্যান্সাররা সহজেই আয় দেশে আনতে পারবে।”
বলা হয়েছিল — “ডলার প্রবাহ বাড়বে, পেপাল একাউন্ট চালু হবে।”
বাস্তবে যা এসেছে:
Xoom (পেপালের একটি রেমিট্যান্স সার্ভিস), যা দিয়ে শুধুমাত্র বাইরের দেশ থেকে টাকা দেশে আানা যায়। বাংলাদেশ থেকে কেউ পেপাল ব্যবহার করে পেমেন্ট দিতে বা রিসিভ করতে পারে না। এমনকি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন, ইনভয়েসিং — কিছুই সম্ভব নয়। তবুও মিডিয়ায় এমনভাবে প্রচার করা হয়েছিল যেন পেপাল পূর্ণ ফর্মেই এসেছে। এটি ছিল খাঁটি “মুলা ঝুলানো” — মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করা।
২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের প্রযুক্তি অঙ্গনে নতুন আলোড়ন — “গুগল পে বাংলাদেশে চালু।” খবরের শিরোনাম, সরকারি কর্মকর্তাদের উক্তি, টেলিভিশন রিপোর্ট—সব জায়গায় একই বার্তা: অবশেষে বাংলাদেশে আসছে গুগল পে, যেটি ভারতের মতো ক্যাশলেস লেনদেনকে বাস্তবে রূপ দেবে।
কিন্তু কয়েকদিন পরেই মানুষ বুঝতে পারে, বাস্তবে চালু হয়েছে গুগল ওয়ালেট, গুগল পে নয়।
👉 Google Pay হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, যেখানে আপনি—
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সুবিধাগুলোর একটিও নেই।
👉 Google Wallet কেবলমাত্র—
এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—সরকার বা মিডিয়া গুগল ওয়ালেটকে গুগল পে হিসেবে প্রচার করেছে, যা একেবারেই ভুল এবং জনসাধারণের মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর মতো কাজ।
উদাহরণ: আপনি এখন গুগল ওয়ালেট দিয়ে কোনো দোকানে গিয়ে QR স্ক্যান করে পেমেন্ট করতে পারবেন না, বা bKash-এর মতো অন্য নাম্বারে টাকা পাঠাতে পারবেন না। তাহলে এই সিস্টেমকে “গুগল পে” বলা কীভাবে যৌক্তিক?
এটা ছিল জনগণের সামনে আরেকটি মুলা ঝুলানো — যেটা দেখে মনে হয়েছিল একটা ডিজিটাল বিপ্লব আসছে, কিন্তু বাস্তবে সেটা ছিল শুধু একটা তামাশা।
দুঃখজনকভাবে, এখনো অনেকেই গুগল ওয়ালেটকেই গুগল পে বলে চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিজেদের অজ্ঞতা ঢাকতে গিয়ে যারা স্পষ্ট করে বলছে যে “গুগল পে ও গুগল ওয়ালেট এক জিনিস নয়” — তাদেরই ব্যঙ্গ করছে, হাস্যকর মন্তব্য করছে। অথচ গুগলের অফিশিয়াল ডকুমেন্টেশন ও সাপোর্ট পেইজেও পরিষ্কারভাবে বলা আছে — এই দুইটি অ্যাপ আলাদা উদ্দেশ্য ও ফিচার নিয়ে কাজ করে।
📌 গুগল পে যেখানে অ্যাকাউন্ট টু অ্যাকাউন্ট পেমেন্ট ও মোবাইল ট্রান্সফারের জন্য ডিজাইন করা, 📌 সেখানে গুগল ওয়ালেট শুধুমাত্র কার্ড স্টোরেজ ও NFC পেমেন্ট করতে পারে।
এখানে ভুল বোঝার সুযোগ নেই, বরং এটি একটা ইচ্ছাকৃত ভুল প্রচার বা অজ্ঞতার গোঁড়ামি, যা প্রযুক্তিগত শিক্ষার অভাবে আরও ছড়িয়ে পড়ছে।
একটি প্রযুক্তি সম্পর্কে না জেনে তার নামে বাহবা দেওয়া যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সেটি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো আরও বেশি বিপজ্জনক — বিশেষ করে যখন সেটা সরকার বা প্রথমসারির মিডিয়া থেকে আসে।
বাংলাদেশে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝেই কিছু “ব্র্যান্ডেড” আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বা নাম সামনে এনে একধরনের “মনস্তাত্ত্বিক তৃপ্তি” দেওয়ার চেষ্টা করে জনগণকে।
এই পুরো কৌশলকে এক কথায় বলা যায় — মুলা ঝুলানোর রাজনীতি। স্বপ্ন দেখানো হয়, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানো হয় না।
পেপাল হোক বা গুগল পে — এই দুটি ঘটনা বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে বিভ্রান্তিকর ঘোষণার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
সরকার যদি বাস্তব উন্নয়ন চায়, তাহলে এইসব আংশিক বা বিভ্রান্তিকর প্রচার বন্ধ করতে হবে।